জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য
ভূমিকা :
বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনের গৌরব উজ্জ্বল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের মুখের ভাষার সতীত্ব রক্ষায় বাংলার মৃত্যু- ভয়হীন দুর্জয় সন্তানেরা আপন বুকের রক্তে পিচ ঢালা কালো রাস্তা কে রঞ্জিত করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এই ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্দমনীয় সংকল্পের গভীরে প্রথিত সে করে রস সঞ্চার করে দেশকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে গেছে। অমর একুশে তাই আমাদের জাতীয় জীবনে বেদনা বিজড়িত এক গৌরবগাঁথা। প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনের বেদনা বিধুর স্মৃতি ও সংগ্রামী চেতনার অমিয় ধারাকে বহন করে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের দ্বারে ফিরে আসে। জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাবার ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য অপরিসীম-
’অমর মহান পূর্ণ-পবিত্র চির একুশের বাণী
বিশ্ব-তোরণে ঐক্য- মিলনে একুশের হার মোনি !’
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহাসিক দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শুধু আমাদের মাতৃভাষা দিবস নয়; প্রতিবছর ’একুশে ফেব্রুয়ারি’ সারা বিশ্বে পালিত হয় ’আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে।
একুশের ইতিহাস :
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। অতঃপর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোঃ আলী জিন্নাহ্ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সফরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন: ‘Urdu only, and Urdu shall be state language of Pakistan.’ এর তিনদিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরালোভাবে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন না এতে কোন কর্ণপাত করেননি। ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
’ মাগো ওরা বলে, /সবার কথা কেড়ে নিবে
তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।
বলো মা, তাই কি হয়?’
একুশের চেতনায় স্বাধীনতার বীজমন্ত্র :
একুশের আন্দোলন যদিও একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল, কিন্তু তাকে বল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সে আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও। বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রথম সফল সংগ্রাম হিসেবে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের ক্ষেত্রেই একুশের চেতনা বাঙালি জনমনে মাইল ফলক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় একুশের চেতনায় বাঙালি জনসাধারণের আত্মজাগরণ ঘটেছিল বলেই সম্ভবপর হয়েছিল। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পর থেকে বাংলার জনসাধারণ বুঝতে পেরেছিল মিষ্টি কথায় অধিকার আদায় হয় না। এর জন্য রক্ত ঝরাতে হয়। পরবর্তীকালে এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ বাংলার জনগণের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। যার বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে ’মা- মাটি- স্বদেশ কবিতায়।
’ ওই মাটিতে থাকে জন্মস্বত্ব, মাতৃভাষার চুক্তিবদ্ধ অধিকার !
ওই মাটিতেই রফিক- জব্বার, সালাম- শফিউর- বরকত..
স্বাধিকার আদায়ে রক্তের তিলক আঁকে/ দ্রোহে- বিদ্রোহে রক্ত- শপথে বাঙালি জাগে
ওই মাটিতে ত্রিশ লক্ষ শহীদের অবিনাশী কাব্য লেখা
ওই মাটিতেই রক্তাক্ষরে লাল-সবুজের পতাকা আঁকা।’
তাৎপর্যের উত্তরণ ও একুশের চেতনা :
”একুশ ভাষার প্রাণ/ একুশ করেছে দান
একুশ মোদের পাথেয়/ একুশকে করো নাকো হেয়।”
বাঙালি জাতির আত্ম উপলব্ধির উত্তরণ ঘটে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর সংগ্রামের মাধ্যমে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে ”একুশে ফেব্রুয়ারি কোন বিশেষ দিন ,ক্ষণ বা তিথি নয়, এটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ। যেন সজীব ’লাভ স্রাবক আগ্নেয়গিরি’, কখনো অন্তরদাহে গর্জন করছে, আর কখনো চারদিকে অগ্নি ছড়াচ্ছে। সত্যি এর ইতিহাস মৃত নয়, একেবারে জীবন্ত।” বাঙালি জাতীয় চেতনার উপলব্ধির ক্রমবিকাশ এখানে এসে গাঢ়তায় রূপ নেয়। সমগ্র জাতি ভাবতে শেখে তার জাতীয় সত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সত্তার কথা।
আরো পড়ুন :- স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব, প্রবন্ধ রচনা
সাংস্কৃতিক বিকাশের চেতনা :
আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। ২১ জাতীয় চেতনার মানসপটে নতুন সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দেয়। সৃষ্টি হয়েছে চেতনা পুষ্ট শিল্পসাহিত্য। মুনীর চৌধুরী রচিত ’কবর’ নাটকটি বাঙালি সংস্কৃতি- চেতনার সাক্ষরই বহন করে। একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রথম বার্ষিকী অর্থাৎ ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাজবন্দী মুনীর চৌধুরীর লেখা ’কবর’ নাটকটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম অভিনিত হয়েছিল রাজবন্দীদের উদ্যোগে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর অনন্য গান : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ এ গান একুশেরই ফসল। একুশের প্রথম কবিতা মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ’কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। এখন একুশ পরিণত হয়েছে আমাদের জাতীয় উৎসবে।
একুশের চেতনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য :
১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উদযাপন করতে গিয়ে তখনকার প্রগতিশীল কর্মীরা কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্ন পায়ে প্রভাত ফেরি ও সমবেত কন্ঠে একুশের গান, শহীদদের কবর ও মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। সেই থেকে এসব কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এসবই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরিণত হয়েছে। এছাড়া ১৯৫৪ সালে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা এবং তারপর থেকে একুশ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রতিবছর অমর একুশের যেসব অনুষ্ঠানমালা এবং বইমেলার আয়োজন করে সব কটি একুশের চেতনার ফল।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে একুশের ভূমিকা অপরিসীম। বাহান্নর এর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্ত বৃথা যায়নি। আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত এ সুদীর্ঘপথে লাখো লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এদেশের মাটি। একুশ আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। মর্যাদা লাভ করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। এ গৌরব একুশের শহীদদের; এ গৌরব সকল বাঙালির।
’ সীমানা পেরিয়ে দিগন্ত ছুয়েছে একুশ বিশ্ববুক
তোমার আমার একুশ আমাদের চেতনার ধ্রুবলোক !’
সম্মানিত পাঠক আমাদের সাইটটি ভিজিট করার জন্য ধন্যবাদ। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন অনেকের স্কুল কিংবা কলেজে বিভিন্ন রচনা প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এজন্য আপনারা অনেকে ইন্টারনেটে সার্চ করে থাকেন। আপনারা যাতে সহজেই রচনাগুলি খুঁজে বের করতে পারেন সেজন্য আপনাদের জন্য সংগ্রহ করেছি এই রচনা গুলি। সকালের সুস্বাস্থ্য কামনা করে মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের এই আয়োজন শেষ করলাম।