নববর্ষ রচনা
ভূমিকাঃ
’ হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/ পুঞ্জ পুঞ্জ রূপ ‘-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস গড়িয়ে আসে পহেলা বৈশাখ। চৈত্র অবসানে বর্ষ হয় শেষ। আসে নতুন বছর। নববর্ষ। পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ট্রাডিশনাল বা প্রচলিত সংস্কৃতি ধারা। আদিকাল থেকেই যেকোন বছরের প্রথম দিনটি নববর্ষ নামে পরিচিত হয়ে আসছে।
নববর্ষের স্বরূপঃ
’ আজ প্রভাতে/সূর্য উঠেছে/হেসে/নববর্ষের/বারতা হাতে
বেজে উঠেছে/গগন তলে ঐ/নবজীবনের/ধ্রুপদী সংগীত-’ (-প্রাকৃতজ টিটন )
পুরাতন বছরের জীর্ণ ক্লান্ত আকৃতির অন্তিম প্রহর সমাপ্ত হয়। তিমির রাত্রে ভেদ করে পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় নতুন দিনের জ্যোতির্ময় সূর্য। প্রকৃতির নিসর্গ মঞ্চে ধ্বনিত হয় নবজীবনের সংগীত। আকাশ সজ্জিত হয় অপরূপ সাজে। পত্রে পত্রে তার পুলক শিহরণ। গাছে গাছে তার আনন্দ উচ্ছ্বাস। পাখির কন্ঠে কন্ঠে নবপ্রভাতের বন্দনা গীতি। দিকে দিকে মানুষের বর্ষবরণের উৎসব আয়োজন। অভিনন্দন শঙ্খধ্বনিতে হয় নতুনের অভিষেক। রাত্রির তপস্যা শেষে এই শুভ দিনের উদার অভ্যুদয়ে মানুষের হৃদয় উৎসারিত কোলোচ্ছ্বাসে ভরে যায় পৃথিবী। নতুন দিনের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা, প্রার্থনা দুঃখ জয়ের।
পহেলা বৈশাখঃ
পহেলা বৈশাখের প্রথম দিন। দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোক উৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল নববর্ষ। অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। তারপর থেকে মোগলরা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ পালন করতো।
বাংলাদেশের নববর্ষ উদযাপনের বৈশিষ্ট্যঃ
পহেলা বৈশাখ বাংলার জনসমষ্টি অতীতের সুখ-দুঃখ বলে গিয়ে নতুনের আহবানে সাড়া দিয়ে ওঠে। জানে এ নতুন অনিশ্চিত সুনিশ্চিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তাই মন সারা দেয়, চঞ্চল হয়। নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেয়। আর সেদিন প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘর বাড়ি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে। আটপৌরে জামা কাপড় ছেড়ে ধবধূর স্থান পোশাক পরিচ্ছেদ করে, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করে পানাহারে মেতে ওঠে। রমনার বটের তলায় জড়ো হয়ে গান গায়, হাততালি দেয়। সবকিছু মিলে দেশটা যেন হয়ে ওঠে উৎসবে আনন্দে পরিপূর্ণ। এছাড়াও এদেশের স্থানীয় কতগুলো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষের বৈশিষ্ট্য সমূহ ফুটে ওঠে। যেমন: মেঘের কাছে জল ভিক্ষা করা, বার্ষিক মেলা, পূণ্যাহ, হালখাতা ইত্যাদি।
বৈশাখী মেলাঃ
নববর্ষ কে উৎসব মুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশ হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিকাজ দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকল প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য। যেমন: চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা ইত্যাদি, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারও থাকে। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের উপস্থিতি থাকে। তারা যাত্রা, পালা গান, কবিগান, জারি গান, গম্ভীরা গান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালিসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমে যে এখনো বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙ্গালীদের কাছে এক অনা বিল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।
নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
আমাদের জীবন ইতিহাসের সার্বিক পটভূমিতে এই দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আমাদের জাতীয় চেতনা অর্থাৎ বাঙালি সত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাঙালি সমাজ সংস্কৃতির অস্থিমদ্দার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের মাহাত্ম্য। রূপকথার জিয়ন-কাঠির মত এ দিনের মর্মস্পর্শে দূরীভূত হয় পুরনো দিনের সকল জরাজীর্ণ। নতুনের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালির ক্লান্ত শ্রান্ত জীবন। প্রতিবছর এই দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় নতুন বার্তা আশার আলো নিয়ে। তাই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে দিনটি হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও বহু জাতি গোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি শান্তির দেশ। এখানে প্রতিটি সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আনন্দ অনুষঙ্গ বলে স্বীকৃত, কিন্তু পহেলা বৈশাখী একমাত্র উৎসব যা কোন ধর্মের বা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অখন্ড বাঙালি জাতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গে দেশের সকল মানুষ অভিন্ন আনন্দ অনুভূতিতে উদ্বেল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মনে করে এক অখন্ড সত্তা রূপে। ফলে জাতিগত সংহতি সুদৃঢ় হয়ে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে দূরত্ব কমে আসে। নববর্ষ পরিণত হয় একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠানে-
’ বাংলা সনের/পহেলা বৈশাখ/হাজার বছরে/বাঙালির প্রাণ…
শাশ্বত এক/প্রেমের বন্ধনে/মিলেছে প্রাণে/ দীন-হীন ভুলে
মুক্ত চিত্তে/মিলাবে মিলবে/অকৃপণ মনে বিলাবে কেবল-
ভুবনের প্রেমে/আনন্দ উল্লাসে/সবার জীবন/আনন্দে ভরে উঠুক।’- (-প্রাকৃতজ টিটন )
উপসংহারঃ
নববর্ষ সমগ্র মানুষের কাছে নবজীবনের ধার উন্মোচিত করে দিক। নতুন বছর যেন মুষ্টিমেয় ধোনির ভোগ-বিলাসের সংকীর্ণ উল্লাসে পরিণত না হয়, দরিদ্র লাঞ্ছিত পীড়িত মানুষের নিষ্ফল বিলাপে যেন পৃথিবী বিষন্ন না হয়ে ওঠে, যুদ্ধদীর্ণ বিশ্বের পাশবশক্তির তাণ্ডব যেন শান্তির শুভ শক্তির কাছে পড়াভূত হয়। আসন পহেলা বৈশাখ কে সামনে রেখে আমরা আমাদের মধ্যকার সকল বিভেদ ও দ্বিধা দূর করতে সচেষ্ট হই। আমরা জাগ্রত হই অখন্ড জাতীয় চেতনায়। নতুন বছর আমাদের সবার জীবনে সুখ সম্ভার বয়ে আনুক এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা। আজ নববর্ষের এই শুভক্ষণে, আসুন, কবি কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি,
’ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, /প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
সম্মানিত পাঠক, ধন্যবাদ আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার জন্য। আজকের এই পোস্টটিতে পহেলা বৈশাখ/নববর্ষ প্রবন্ধ রচনাটি তুলে ধরেছিলাম। আশা করি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমরা আপনাদের সুবিধার্থে বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক থেকে এই প্রবন্ধ রচনা, অনুচ্ছেদ, দিনলিপিগুলো সংগ্রহ করে আপনাদের কাছে তুলে ধরি। যাতে আপনারা এখান থেকে নিয়ে স্কুল কিংবা কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষাগুলোতে ভালো রেজাল্ট করতে পারেন। সকালে সুস্বাস্থ্য কামনা করে এবং ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের এই পোস্ট শেষ করলাম।