বাংলা নববর্ষ অনুচ্ছেদ- ১
পৃথিবীর সর্বত্র নববর্ষ একটি প্রথা বা প্রচলিত সংস্কৃতি ধারা। আদিকাল থেকেই যে কোন বছরের প্রথম দিনটি নববর্ষ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। পুরাতন বছরের যে জন্য ক্লান্তি রাত্রি অন্তিম প্রহর হলো ঘোষিত। দিকে মানুষেরা বর্ষবরণের উৎসব আয়োজন করে থাকে। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোক উৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল বাংলা নববর্ষ। অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষের দিনটি প্রতিদিনের মতোই একটি সাধারণ দিন মাত্র। প্রতিদিনের মতো এ দিনটিও যথানিয়মেই উদয় দিগন্তে ভেসে ওঠে। আলোক প্লাবনে পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়। পাখি গান গায়। গাছে গাছে শিহরণ জাগে। কিন্তু তবু দিনটি অন্য দিনগুলোর চেয়ে স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট। বর্ষ প্রদক্ষিণের পথে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যে মহিমা ভাস্বর। এদিন আমাদের কাছে মুক্তির বার্তা বয়ে আনে। পহেলা বৈশাখ বাংলার সমষ্টি অতীতের সুখ দুঃখ ভুলে গিয়ে নতুনের আহবানে সাড়া দিয়ে ওঠে। জানে এ নতুন অনিশ্চিতের সুনিশ্চিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। আর সেদিন প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘর বাড়ি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে।
আটপৌরে জামা কাপড় ছেড়ে ঢপ দূরত্ব পোশাক পরিচ্ছদ করে, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে দেখা করে পানাহারে মেতে ওঠে। রমনার বটের তলায় জড়ো হয়ে গান গায়, হাততালি দেয়। সবকিছু মিলে দেশটা যেন হয়ে ওঠে উৎসবে আনন্দে পরিপূর্ণ। নববর্ষের উৎসব গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নববর্ষের পল্লী অঞ্চলের কোথাও বেশ বর্ণাঢ্য মেলা বসে। মেলার বিচিত্র আনন্দ অনুষ্ঠানে, কেনাবেচার বাণিজ্যিক লেনদেনে, মিলনের অমলিন খুশিতে, অবারিত অন্তরপ্রিতের স্পর্শে নববর্ষের বিশেষ দিনটি মুখর হয়ে ওঠে। নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এদিন সাধারণত সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। এটা গোটা জাতির তথা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অখণ্ড বাঙালি জাতির উৎসব। নববর্ষ পরিনত হয় একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠানে।
আরো দেখুনঃ- বৈশাখী মেলা দেখার দিনলিপি লিখ
পহেলা বৈশাখ অনুচ্ছেদ- ২
পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। দিনটি বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গের নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোক উৎসব। আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতিফলন নববর্ষ। অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। তারপর থেকে মোগলরা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পয়লা বৈশাখ পালন করত। বর্তমানে নগর জীবনে নগরসংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়। পয়লা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। নববর্ষ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোন বৃহৎ লোকের ধারে অতিপ্রত্যশীল নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করে। এদিন সাধারণত সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুরি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে, আর ছেলেরা পড়ে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে। এদিন সকালবেলা পান্তা ভাত খাওয়া ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা।
এভাবে লুকোস বর্ষ বরণ প্রথাগুলোর কোনটির অনুসরণের মাধ্যমে গ্রামীণ ঐতিহ্য অনেকটা সংরক্ষিত হচ্ছে। বর্ষবরণের চমক রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মিলন মেলায় পরিণত হয়। নববর্ষের প্রথম এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। সায়ানটের উদ্যোগে জোনাকী নরম নার্ভ টমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান- ’এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা ইনস্টিটিউট এর বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। এখানকার শিল্পীদের আহবান করে তোলে নয়ন- মনোহর। এ শোভাযাত্রা উপভোগ করে সকল শ্রেণীর আবাল -বৃদ্ধ- বনিতা। এদিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টিএসসি এবং চারুকলা সহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। বাংলা নববর্ষ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে ৩ পার্বত্য জেলায় (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সামাজিক উৎসব ’বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়।
বৈশাখী মেলা অনুচ্ছেদ- ৩
আমাদের জাতীয় জীবন ইতিহাসের সার্বিক পটভূমিতে নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ও পরিসীম। আমাদের জাতীয় চেতনা এবং বাঙালি সত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাঙালি সমাজ সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের মহাত্ম্য। রূপকথার জীবন কাঠির মত এদিনের মর্ম স্পর্শে দূরীভূত হয় পুরনো দিনের সকল জরাজীর্ণ। নতুনের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালির ক্লান্ত ও শ্রান্ত জীবন। প্রতিবছরের দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় নতুনের বার্তা আশার আলো নিয়ে। তাই জাতীয় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই এই দিনটি হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি শান্তির দেশ। এখানে প্রতিটি সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব। এগুলোর অধিকাংশই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আনন্দ অনুষঙ্গ বলে স্বীকৃত কিন্তু পহেলা বৈশাখী একমাত্র উৎসব যা কোন ধর্মের বা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এতে গোটা জাতির তথা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অখন্ড বাঙালি জাতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গে দেশের সকল মানুষ একই সময় অভিন্ন আনন্দ অনুভূতিতে উদ্বেল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মনে করে এক অখণ্ড সত্তা রূপে। ফলে জাতিগত সংহতি ও ঐক্য হয়ে মানুষের ধর্মে ধর্মে বর্ণে বর্ণে দূরত্ব কমে আসে।
নববর্ষ পরিণত হয় একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠানে। নববর্ষ সমগ্র মানুষের কাছে নবজীবনের ধার উন্মোচিত করে দিক। নতুন বছর যেন মুষ্টিমেয় ধোনির ভোগ-বিলাসের সংকীর্ণ উল্লাসে পরিণত না হয়, দারিদ্র লাঞ্ছিত পীড়িত মানুষের নিষ্ফল বিলাপে যেন পৃথিবী বিষন্ন না হয়ে ওঠে। যুদ্ধদীর্ণ বিশ্বের পাশবশক্তির তাণ্ডবের যেন শান্তির শুভ শক্তির কাছে পরাভূত হয়। আসন পহেলা বৈশাখ কে সামনে রেখে আমরা আমাদের মধ্যকার সকল বিভেদ ও দিদা দূর করতে সচেষ্ট হই। আমরা জাগ্রত হই অখন্ড জাতীয় চেতনায়। আমরা রিদ্ধ হই ভবিষ্যতের গর্বিত প্রেরণায়। নতুন বছর আমাদের সবার জীবনে শোক সোমবার বয়ে আনুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আজ নববর্ষের এই শুভক্ষণে সকলে তাদের জরাজীর্ণ অতীত ভুলে গিয়ে নতুন পথের আলোয় আলোকিত হোক। নববর্ষে যেন ফিরে পাই আমাদের সেই হৃদ গৌরব। আবার যেন আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আন্তরিক প্রসন্নতা ও কল্যাণী ইচ্ছার ভাবরসে। আবার যেন আমরা বর্ষারম্ভের উৎসবে খুঁজে পাই মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করার মহত্ব। আজ নববর্ষ উৎসব সত্যের গৌরবে, প্রেমের গৌরবে, মঙ্গলের গৌরবে, নির্ভীক মহত্ত্বের গৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।
সম্মানিত পাঠক আমাদের সাইটটি ভিজিট করার জন্য ধন্যবাদ। আজকের এই পোস্টটিতে আপনাদের জন্য বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ, বৈশাখী মেলা সম্পর্কে তিনটি অনুচ্ছেদ নিয়ে এসেছিলাম। আশা করি আপনাদের ভালো লেগেছে। স্কুল কিংবা কলেজের যে কোন পরীক্ষায় আপনি এখান থেকে অনুচ্ছেদ নিয়ে লিখতে পারবেন। সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করে এবং ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের এই পোস্ট শেষ করলাম।